মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয়েছিল ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট | তাজপুর ত্রাণশিবির আর শঙ্করপুর ঘুরে যখন পুরোনো দীঘা পৌঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আকাশে ঘন কালো মেঘ, বৃষ্টি পড়ছে, দীঘার সমুদ্র তখনই যেন কেমন ফুলে উঠে ফুঁসছে | বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম প্রিয় সমুদ্রের দিকে | দীঘার সমুদ্রের এমন রূপ এর আগে কখনও দেখিনি | তখনই যেন কেমন একটু ভয় পেলাম, শুনশান ফাঁকা দীঘার বাঁধানো পাড়, পুলিশের টহলদারি আর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ছাড়া কেউ নেই; বেশকিছু ছবি সংগ্রহ করে পৌঁছালাম গেস্ট হাউসে| ফাঁকা গেস্ট হাউস দুজন কর্মচারী ও সেখানকার ম্যানেজার। আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন | আমরা দলে চারজন | মুখোমুখি দুটো ঘর | গেস্ট হাউসে তখনও কারেন্ট আছে দেখে একটু স্বস্তি পেলাম | ক্যামেরা, মোবাইল ফোনের ব্যাটারী চার্জে বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু জলখাবার খেয়ে নিলাম, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি| সারাদিনের তোলা ছবি পাঠানো আর এডিটিং পর্ব শেষ হতে রাত হয়ে গেল| রাতের খাবার তাড়াতাড়ি শেষ করে শুয়ে পড়লাম | শুনলাম ঝড়ের ল্যান্ডফলের টাইম আরোও এগিয়ে এসেছে , সকাল সাড়ে ছ’টা| ইয়াস ল্যান্ডফল করবে ওড়িষার বালাসোরের কাছে ধামড়ায়| ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা পশ্চিমবঙ্গের ঊপকূলীয় অন্চল | বিশেষত পূর্ব মেদিনীপুর | আমরা আছি দীঘায় | রাত বাড়ার সাথে ঝড়ের দাপট বাড়তে লাগলো | পাওয়ারকাট করে রাখা হয়েছে | রাত তিনটে নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল, বাড়ীটা যেন কাঁপছে, বন্ধ ঘরের বাইরে থেকে ঝড়ের অদ্ভুত শব্দ, ইন্টারনেটে চেক করলাম ঝড়ের লোকেশন আর নিজের, বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল| জেগে বসে রইলাম| ভাইবোনদের আর বন্ধুদের চ্যাটে জিজ্ঞাসা করলাম কলকাতার কি অবস্হা, কোনো উত্তর পেলাম না| সাড়ে চারটে অবধি ঠায় একভাবে বসে রইলাম ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি, জামাকাপড় গুলোও রেডি রাখলাম; যেকোনো মুহূর্তে যদি বেড়িয়ে পড়তে হয় ! একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম | কাঁচে ঘেরা রাস্তার ধারের বড় বারান্দার দরজা দিয়ে আসা দিনের আলোয় ঘুম ভাঙলো | ঝড়ের প্রকোপ একটু থেমেছে| সাড়ে ছটা নাগাদ রেডি হয়ে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম | নিউ দীঘার অমরাবতী পার্ক ছাড়িয়ে আরও কিছুটা ভিতরের দিকে আমরা ছিলাম| সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য পুরানো দীঘা| ঝড়ের দাপট আবার বাড়তে শুরু করেছে, ঝোড়ো হাওয়ায় জঙ্গলের ভিতর কিছু গাছ পড়লেও রাস্তার উপর তখনও পড়েনি তাই যেতে কোনোও অসুবিধা হলো না | গাড়ী দাঁড় করানো হলো পুরানো দীঘার সৈকতাবাসের ঠি ক সামনে | শুরু হয়েছে সাংঘাতিক ঝোড়ো হাওয়া, তীব্র বৃষ্টির ঝাপটা, সমুদ্রের জল তখনই সৈকতাবাসের পার্কে আছড়ে পড়ছে | আমার সঙ্গে থাকা সিনিয়ররা ততক্ষণে নেমে পড়েছেন যে যার ক্যামেরা হাতে| ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দাপটে গাড়ীর দরজা খোলাই দায় হয়ে দাঁড়ালো, নোনা জলে মিররলেস ক্যামেরা নষ্টহওয়ার ভয়ে কোনোরকমে জানলা থেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, সম্ভব নয় , গাড়ী থেকে যখন নামলাম সমুদ্রের জল পার্ক ছাপিয়ে গাড়ীর সামনে আসতে শুরু করেছে | ঝোড়ো হাওয়ার দাপট দাঁড়াতে দিচ্ছে না, বৃষ্টির জল আর সমুদ্রের নোনা জল বারবার ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা করে দিচ্ছে, নিমেষের মধ্যে জল বাড়তে শুরু করেছে পার্কে , এগোতে কিংবা পিছোতে পারছি না, পার্কের ধারে রাখা আমাদের গাড়ীটা তখন ভেসে উঠেছে জলে | এবার আমাদের এখান থেকে এখনই চলে যেতে হবে নাহলে বিপদ| সবাই গাড়ীর কাছে পৌঁছালেও আমি পারছি না! বৃষ্টি আর হাওয়ার ঝাপ্টা, সমুদ্রের ঢেউয়ের জলের স্রোত আমায় এগোতে দিচ্ছে না, জলের স্রোত এমন ভাবে যাচ্ছে পার্কের সিঁড়ি থেকেই আমি নামতে পারছি না | আমার সঙ্গে থাকা একজন সিনিয়র কোনরকমে আমায় টেনে নামালেন | আমি সম্পূর্ণ বাকরূদ্ধ| দীঘার প্রকৃতির এমন ভয়ঙ্কর রূপ, সমুদ্রের এই ভয়াল রূপ এর আগে কখনও দেখিনি | গাড়ীতে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেই জায়গা ছাড়লাম, সমুদ্রের জলও বাড়ছে রাস্তায়, গাড়ী ভেসে উঠছে এরপর আর এগোনো যাবে না, জলের স্রোতে গাড়ী ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে | কয়েকজন সংবাদমাধ্যম তখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে সেখান থেকে লাইভ করে চলেছে, দেখতে দেখতে আমরা বেড়িয়ে গেলাম| সোজা নিউ দীঘার গেস্ট হাউস | ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল ১১টা নাগাদ আবার বেড়িয়ে পড়লাম | এবারও গন্তব্য যদিও সেই ওল্ড দীঘা নেমে পড়লাম নিউ দীঘার সী সাইড পিকনিক স্পটের সামনে | আগের ট্রমা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি | সমুদ্রের পাড়ের সব হোটেলের সামনে হাঁটু জল, সেই জল বেড়ে ক্রমশঃ রাস্তার ধারের হোটেল অবধি চলে আসছে| গোরু, কুকুর জল সাঁতরে কোনোরকমে ঠাঁই খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেভাবে সমুদ্রের জল রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে তাকে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির বিপরীতে ঠেলে দীঘার পাথর বাঁধানো পাড় অবধি কি ওয়াচ টাওয়ার অবধি পৌঁছানো সমীচিন লাগলো না | তাই জল ঠেলে আবার গাড়ীর দিকে ফিরে গেলাম সবাই | ওল্ড দীঘার পুরোনো মার্কেট এড়িয়া, ঝোড়ো হাওয়ার দাপট আবারও বেড়েছে | সমুদ্রের ধারে টিনের ছাউনির যে মার্কেটটা ছিল সেটা ধুলিস্যাৎ হয়েছে, পড়ে আছে শুধু বোল্ডার| একটা লোক হাত নেড়ে একজন মহিলাকে। অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে, জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওদের এখানে দোকান ছিল, সকাল আটটা নাগাদ সমুদ্রের জল উঠে এসে বড় বড় বোল্ডারের ধাক্কায় প্রায় ২০-২৫ টাদোকান সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে, উনি সেই ঘটনারই বর্ণনা দিচ্ছেন, তার তিরিশ চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি দীঘার এমন রূপ দেখেননি| কিছু দোকানদার কাজুবাদাম আর ঝিনুকের গয়নার দোকানগুলো থেকে দোকানিরা কাদাজল মাখা জিনিসপত্র বের করে বাইরে ফেলছে | বেশীরভাগ দোকানই বন্ধ। চারিদিকে তখন স্টলের লোকেদের হাহাকার শুধু শোনা যাচ্ছে, “সব শেষ হয়ে গেল, দীঘার সব শেষ হয়ে গেল”| জলের ঝাপটায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না, আবারও গেলাম সেই সৈকতাবাসের দিকে, রাস্তার অবস্হা তখনও খারাপ, ডি এস ডি এ বিল্ডিং এর সামনে তখনও জল। একটা গাড়ী তখনও উল্টে পড়ে আছে | দুটো গাড়ী চেন দিয়ে বাঁধা হোটেলের গেঁটের সাথে| বৃষ্টি না পড়লেও সমুদ্রের নোনা জল ঝোড়ো হাওয়ায় চলে আসছে অনেক দূর | দুপুরের দিকে গেস্ট হাউসে ফিরলাম ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে এবার ছবি এডিট ও তা যথাস্থানে পাঠানোর পালা| যে যার ঘরে সবাই ব্যস্ত একই কাজে | ….