বিদ্বজনেরা বলেন বাঙালি চিরকালই বর্ষশেষের উৎসব পালনেই অভ্যস্থ থেকেছে দীর্ঘকাল, পয়লা বৈশাখের মান বাঙালি ব্যাবসায়ীরাই রেখে এসেছেন বরাবর। চৈত্রের শেষ সপ্তাহ, বড়বাজারের সোনাপট্টির গলিতে হাল খাতার দোকানগুলোয় ভিড় জমেছে দোকানীদের, লাল খাতা কেনার। আগে খাতা তৈরী হতো তুলোট কাগজের, গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সেই হ্যান্ডমেড কাগজ আসতো, তাই দিয়েই হালখাতা বানানো হতো। কারিগররা তৈরী করতো কাগজ, মলাট। কিন্তু এখন মিলের কাগজে খাতা তৈরী হয়। ছোটো বড় নানান আকৃতির হাল খাতা যাদের নামও ভিন্ন, প্রয়োজনমাফিক; জাবদা, খতিয়ান, ক্যাশ, লেজার, রেজিস্টার আরোও কত কি। ”আগে এইসব খাতার বিক্রি অনেক বেশী ছিল, কম্পিউটার এসে যাওয়ায় তার বিক্রি অনেক কমে গেছে। জিএসটির ফলে রেজিস্টার খাতার চাহিদা বেড়েছে। দড়ি বাঁধা জাবদার চল অনেকটা কমেছে। বেশীরভাগ দোকানই এখন ব্যাবসার জন্য বাঁধানো লাল খাতাই কেনে; তবে সোনার দোকানে, মাছের ব্যাবসায়ে, মুদিখানায় এখনও জাবদার চল আছে। মারোয়াড়ী ব্যাবসায়ীদের গদি ঘরে মুলত ২৮ ইঞ্চি লম্বা, সাড়ে ১২ ইঞ্চি চওড়া হলুদ পাতার দোফোরদি খাতা ব্যাবহার হতো একসময়য়; কম্পিউটারের রমরমায় সেই খাতার প্রয়োজন মিটেছে এখন”, জানালেন, বড়বাজারের প্রায় দুশো বছরের খাতা ব্যাবসায়ী ‘বৈদ্যনাথ সাহা মন্মথনাথ সাহা’র বর্তমান কর্নধার উপামান্যু সাহা। করোনা আর লকডাউনের জেরে বিগত দুবছর মন্দার মুখ দেখেছে মধ্যকলকাতার বৈঠকখানা বাজার। ক্যালেন্ডার, খাতা তৈরির দোকানগুলো তাই এখন বর্ষবরণের বিগত দুবছরের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় ব্যাস্ত। রহিম, শাহজাহান, সাকিব, বাবরদের এখন শ্বাস ফেলারও সময় নেই। কেউ ব্যাস্ত লাল মলাটে আঠা লাগাতে, কেউ সেটাকে সযত্নে ভাঁজ করে খাতায় পেস্ট করে দিচ্ছে। কেউ আবার জাবদা সেলাই করছে। অর্ডারের খাতা পাঠাতে হবে সব দোকানে দোকানে। হাতে মাত্র আর কয়েকটাদিন। তারপরই বাঙালির পয়লা বৈশাখ ওরফে ব্যাবসায়ীদের হালখাতা। “আমাদের খাতা তৈরী শুরু হয়ে যায় সেই জানুয়ারী থেকে। এইসব খাতা সব বড় বড় ব্যাবসায় যায়। এইসব খাতা চলে যায় মিষ্টির দোকানে, কাপড়ের দোকানে, সিমেন্ট বালির দোকানে, লোহার দোকানে, বিভিন্ন বড় বড় ব্যাবসায়ে” জানালেন শেখ নওশাদ যিনি প্রায় ষাটের দশক থেকে এই কাজের সাথে যুক্ত আছেন । “সে এক সময় ছিল যখন পয়লা বৈশাখ মানেই আমশাখা, কদম্ফুলে দোকান সাজানো, হালখাতা, নতুন জামা, দোকানে দোকানে মিষ্টি, ক্যালেন্ডার বিতরণ। আগে বিভিন্ন দোকানে, ব্যাবসার জায়গায় এক বিরাট প্রস্তুতি লেগেই থাকতো বর্ষবরণের আগে থেকে। এখন সে দিনও গেছে ব্যাবসার রমরমাও নেই; এই পয়লা বৈশাখেই এক সময় তিন থেকে চারটে হালখাতা কেনা হতো, জাবেদা খাতা ২টো, খতিয়ান ২টো এছাড়াও জমা খরচের খাতা; যতদিন যাচ্ছে এখন সারা বছরে একটা জাবেদা খাতার পাতা ফুরোয় না”, জানালেন উত্তরকলকাতার শতবর্ষ পুরোনো এক মুদিখানা ব্যাবসায়ী। সময় বদলেছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি আর হালের অনলাইন ব্যাবসায় বাঙালি ভুলতে বসেছে জাবেদা, খতিয়ান, দোফোরদির নাম; আর কিছুদিনবাদেই হয়তো এদেরও স্থান হবে কোন সংগ্রহশালায়।