প্রতিবেদন – জয়ন্ত সাউ
ভাগীরথী নদীর জন্ম গঙ্গোত্রী হিমবাহের প্রান্তভাগ বা স্নাউট থেকে, যা গোমুখ নামে পরিচিত। অনেকটা গরুর মুখের আকৃতি। গোমুখে এখন গরুর আকৃতির মুখ আর নেই। ২০১৩ সালের বিধ্বংসী বন্যায় এই অংশটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। ভুজবাসা থেকে গোমুখ যাওয়ার রাস্তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। গোরুর মুখের আদল আর নেই, এখন এই অংশটি দুটি ভাগ হয়ে গেছে সেটিই এখন ভাগীরথীর উৎস।
কলকাতা থেকে হরিদ্বার
কথায় আছে বাঙালীর পায়ের তলায় সর্ষেফুল, সুযোগ সে পেলেই বেড়িয়ে পড়ে; সুতরাং আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। প্রতি বছরই সুযোগ বুঝে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে চলে যাই একটু দূরে কোথাও প্রকৃতির মাঝে কিছুটা সময় কাটাতে। সেবারও তাই গিয়েছিলাম ভাগিরথীর উৎসের সন্ধানে। উত্তরাখন্ডের বন্যা, ধস, করোনা অতিমারী কিংবা লক ডাউনের জীবনের বেশ কিছুটা আগে। দূরে কোথাও গেলে একটু বড় দল না হলে ঠিক জমে না। তাই ছোট বড় মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ালো দশে।
কলকাতা থেকে প্রথম গন্তব্য হরিদ্বার। পৌঁছালাম রাত বারোটার সময়। রাত কাটানোর ব্যাবস্থা হলো ভোলাগিরি আশ্রমে। পরেরদিন সকালে হরিদ্বার থেকে গেলাম হৃষিকেশ। সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া করে রওনা দিলাম গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে।
উত্তরকাশী
হৃষীকেশ থেকে ধরাসু হয়ে উত্তরকাশী পৌঁছালাম। হরিদ্বার থেকেও সরাসরি বাসে উত্তরকাশী পৌঁছান যায়; হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীর দুরত্ব ২৯০ কিলোমিটার। হিমালয়ের বুকে ভাগীরথীর তীরে উত্তরকাশী। ভাগীরথীর পথ এখানে উত্তরমুখী হওয়ায় জায়গার নাম উত্তরকাশী। উত্তরকাশীতে দুপুরের খাবার খেয়ে জায়গাটা কিছুটা ঘুরে দেখলাম। এখানে একরাত থেকে পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করলাম। সঙ্গ নিলো কখনও গাড়োয়াল হিমালয়ের ধাপে ধাপে পাইন, দেবদারুর জঙ্গল, আবার কখনও খরস্রোতা ভাগীরথী।
গঙ্গোত্রী
প্রথমে উত্তরকাশী থেকে গাঙনানি, এখানে একটি উষ্ণ প্রসবন রয়েছে। গাঙনানি থেকে লঙ্কা, লঙ্কা থেকে ভৈরব ঘাঁটি; বিশ্বের উচ্চতম সেতুটি এখানে লঙ্কা আর ভৈরব ঘাঁটির মাঝে জাহ্নবী নদীর উপর রয়েছে; আগেরদিন হৃষিকেশ থেকে শুরু করে মোট ২৪৯ কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে গঙ্গোত্রী পৌঁছালাম। বরফে মোড়া হিমালয়ের মাঝে গঙ্গোত্রী মন্দির। মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পাহাড়ে বুকে। এখানেই খরস্রোতা ভাগীরথী পাহাড়ের বুক চিরে সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। সে এক অদ্ভুত অনাবিল দৃশ্য। গঙ্গোত্রীর মন্দিরে চারপাশ সমতল, মন্দিরের পাশেই রয়েছে পূজার্চনার নানাবিধ জিনিসের দোকান। এই মন্দিরে প্রতিদিন রাত আটটার সময় পূজো ও আরতি হয়। গঙ্গোত্রীতে আমরা সেইদিন রাতে থেকে পরেরদিন সকাল সকাল গোমুখের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ ট্রেক রূট
গোমুখের উচ্চতা প্রায় ৪২৫৫ মিটার। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের দুরত্ব ১৯ কিলোমিটার। গোমুখ যাওয়ার পথেই মিলবে কুলি, গাইড আর ঘোড়া। কিছুটা রাস্তা হেঁটে যাওয়ার পর আমরা ঘোড়া নিলাম। পাহাড়ের গায়ে দুধারে সারি সারি পাইন, বুনো তেউড়ির জঙ্গল। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্নার জল খেতে আসছিল হরিন শাবকের দল। বরফে মোড়া ভাগীরথী পাহাড়ের চূড়ো এখানে চলার পথের সঙ্গী। ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছালাম চিরবাসা। চিরবাসার উচ্চতা ৩৫০০ মিটার। এখানে কিছু খাবার খেয়ে ও বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলার শুরু। সঙ্গী বরফাবৃত ভাগীরথী পর্বতমালা। আরো ৫ কিলোমিটার ঘোড়ায় করে আমরা সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ ভুজবাসা পৌঁছালাম। এখানে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী। স্থানীয় একটি আশ্রমের ডরমিটরিতে সকলের রাতে থাকার ব্যাবস্থা হল। যদিও এখন সেখানে এই আশ্রম ছাড়াও গাড়োয়াল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে রাতে থাকার ব্যাবস্থা আছে। পরের দিন সকাল সাতটায় রওনা দিলাম গোমুখের উদ্দেশ্যে। ভুজবাসা থেকে গোমুখের রাস্তা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। গোমুখ যাওয়ার পথেই চোখে পড়বে শিবলিঙ্গ পর্বত শিখর। ৬৫৪৩ মিটার উঁচু। প্রথম ৪ কিলোমিটারের পরে ১/২ কিলোমিটার আর কোনো রাস্তাই নেই। উঁচু নীচু বোল্ডারে ভর্তি। এখানে আর ঘোড়া যায় না। তাই পায়ে হেঁটেই পার হতে হলো এই পথ। যদিও ২০১৩ বন্যার পর থেকে এই পথ প্রায় সম্পুর্ণ চলাচলের অযোগ্য হয়ে গেছে।
৬৫০০ – ৭০০০ মিটার গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার। চৌখাম্বা পাহাড়ের পশ্চিমদিকের ঢাল বেয়ে নেমে শেষ হয়েছে একেবারে গোমুখে এসে। গাড়োয়াল হিমালয়ের সবচেয়ে বিশাল হিমবাহটি তখন ছিল ২৪ কিলোমিটার লম্বা আর ২ থেকে ৪ কিলোমিটার চওড়া। কয়েক হাজার ফুট নীচের দিকে নেমে এসেছে এই গ্লেসিয়ার পয়েন্ট। পাথুড়ে মাটি সবসময়ই ঝড়ে পড়ছে। আমরা লাঠি ঠুকে এগোতে লাগলাম সেই ১/২ কিলোমিটার পথ। চারিদিকের পাহাড় বরফের চাদরে মোড়া। এখানে গঙ্গার নাম হয়েছে ভাগীরথী। পাথুরে পথে আরোও কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেলাম বিশালাকায় এক গুহামুখ, ঠিক যেন গোরুর মুখের আদল। যার ভিতর থেকে তীব্র গতিতে বেরিয়ে আসছে গঙ্গা। জলবায়ু আর প্রকৃতির পরিবর্তনে গোমুখের এই আদলও আজ আর নেই যেমন প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিশ্চিহ্ন হয়েছে গোমুখ যাওয়ার পথ। তাই সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আজও আমার কাছে বহুমুল্যবান স্মৃতি হয়েই থাকবে। এই হিমবাহের তিনদিকে তিনটি তীর্থক্ষেত্র রয়েছে। এগুলো হল ব্রম্ভতীর্থ গঙ্গোত্রী, বিষ্ণু তীর্থ বদ্রী বিশাল, আর তিন মহেশ্বর তীর্থ কেদারনাথ।
তপোবন
গোমুখ দর্শন করে আমরা ভুজবাসায় ফিরলাম। সেখান থেকে রওনা দিলাম তপোবন; শিবলিঙ্গের পাদদেশে ৪৩৫৪ মিটারেরও বেশী উচ্চতায় অবস্থিত তপোবন। এখান থেকে ভাগীরথীর চুড়াগুলো আরোও ভালোভাবে দেখা যায়। তপোবনের স্বর্গীয় পরিবেশে দুদিন রইলাম। গোমুখ থেকে তপোবনের রাস্তা মাত্র ৪ কিলোমিটার কিন্তু খুবই খারাপ। গাইড ছাড়া এখানে যাওয়া যায় না। প্রতি মুহূর্তে পাহাড়ে ধস নামছিল। সাধারণ তীর্থযাত্রী অথবা ভ্রমণার্থীদের জন্য এই পথ নয়। তপোবন থেকে মাতৃপিক, কেদারডোম, খড়চাকুন্ড পর্বত শিখরগুলো খুব ভালো ভাবে দেখা যায়। ভাগীরথী আর কেদারডোমের শৃঙ্গগুলো যেন তপোবনের মাথায় ছাতার মত দাঁড়িয়ে। তপোবনের উল্টোদিকেই রক্তবন এখান থেকে দেখা যায় কৈলাস। আরোও কিছুটা এগোলে বাসুকী পর্বত। তার পাশে মেরু পর্বত। গ্লেসিয়ার ছাড়িয়ে ৩ কিলোমিটার দূরে নন্দনবন, উচ্চতা ৪৪০০ মিটার। তপোবন থেকে পরের দিন সকালে আমরা নন্দনবন গেলাম। সেখান থেকে ভাগীরথী, কেদারডোম, শিবলিঙ্গের দৃশ্য আরোও সুন্দর। নন্দনবন থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাসুকী তালে রাতে থাকার ব্যাবস্থা ক্রা হলো। পরেরদিন ফেরার পালা। তপোবন থেকে ভুজবাসা, ভুজবাসা থেকে গঙ্গোত্রী, গঙ্গোত্রী থেকে যোশীমঠ হয়ে আমরা ফিরলাম হরিদ্বার; সেখান থেকে কলকাতা। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকবছর। জলবায়ু বদলের কারণে বদলেছে প্রকৃতিও, সেই ভুবনভোলানো প্রকৃতি আর কখনও ফিরবে না; গোমুখের সেই দৃশ্য আজ আর ফেরানো সম্ভব না হলেও তা চিত্রিত হয়ে রয়ে গেছে আমার স্মৃতির পাতায়।
কলকাতা থেকে গঙ্গোত্রী হয়ে গোমুখ ট্রেক এর হাল হদিস –
মে মাস থেকেই শুরু হয়ে গেছে চারধাম যাত্রা। যারা একটু দূরে মানুষের ভিড় এড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে ঘুরে আসতে চান কিংবা রয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তারা ঘুরে আসতে পারেন গঙ্গোত্রী হয়ে গোমুখ গ্লেসিয়ার; গঙ্গার উৎপত্তি স্থল। হরিদ্বার, উত্তরকাশী, গঙ্গোত্রী, ভুজবাসা এইসব জায়গাতেই গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের নিজস্ব থাকার ব্যাবস্থা আছে; তাদের ওয়েববসাইটে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভালো।
হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার।
হরিদ্বার থেকে বাসে উত্তরকাশী ১৯০ কিলোমিটার। সময় নেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। এখানে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে রাতে থাকার ব্যাবস্থা আছে।
উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী ১০০ কিলোমিটার; যে কোনো বাস অথবা গাড়ীতে যাওয়া যায়। উত্তরকাশীতেও অনেক প্রাইভেট হোটেল ও গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে রাতে থাকার ব্যাবস্থা আছে। আগে থেকে অনলাইনে বুক করে রাখলে ভালো।
গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ ট্রেক রুট ১৯ কিলোমিটার ।
গঙ্গোত্রী চেকপোস্ট থেকে চিরবাসা ৯ কিলোমিটার। এখানে বিশ্রাম নিয়ে ও কিছু খাবার খেয়ে রওনা দেয়া যায়।
চিরবাসা থেকে ভুজবাসা ৫ কিলোমিটার। ভুজবাসাতেও বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা আছে। রাত কাটানোর জন্য এখানে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউস আছে। এছাড়া একটি আশ্রমও আছে সেখানেও রাতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা আছে।
ভুজবাসা থেকে গোমুখ ৪ কিলোমিটার। ভুজবাসা পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠে গেলেও রাস্তা খুব খারাপ হওয়ায় তারপর গোমুখ পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই যেতে হবে।
বর্তমানে গঙ্গোত্রী হয়ে গোমুখ অথবা চারধাম যেতে হলে অনলাইন রেজিস্ট্রেশান বাধ্যতামূলক ।
অনলাইন রেজিস্ট্রেশান লিঙ্ক – ( চারধামযাত্রা ২০২২ )
সহায়তা নম্বর ঃ ০১৩৫-২৫৫৯৮৯৮, ২৫৫২৬২৭, ৩৫২০১০০
টোল ফ্রী নম্বরঃ ১৩৬৪, অন্যান্য রাজ্যের জন্যঃ +৯১ ১৩৫ ১৩৬৪
সময়ঃ সকাল ৭টা – রাত ৯টা