রাখি কোলে
বাঙালির যে কোন অনুষ্ঠানে দেবদুতের মতো আবির্ভাব ঘটে পঞ্জিকার। অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই আলমারির ধুলো ঝেরে বের করে আনতে হয় পঞ্জিকাটি। বাঙালির সকল ধরনের অনুষ্ঠানের সঠিক দিন, তারিখের হিসেব কষার জন্য পাঞ্জির জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এই পাঞ্জির গ্রহণযোগ্যতা এখন কি অটুট আছে নাকি সনাতনী বাঙালির ঠাকুর ঘর তার রূপ বদলেছে পঞ্জিকাটিকে বাদ দিয়ে। পঞ্জিকার ব্যবহার আজও সকল অনুষ্ঠানেই দেখা যায়।তা সে গৃহপ্রবেশ হোক বা সাধভক্ষণ বা বিবাহ কিনবা শ্রাদ্ধ। পরনে সাধা ধুতি, নামাবলী ও হাতে বেনীমাধব শীলের পঞ্জিকা – বাঙালি ব্রাহ্মনের এই রূপ বড়ই পরিচিত আমদের কাছে। কিন্তু পঞ্জিকার শুরু কোন পুরহিতের হাত ধরে হয় নি। লোককথা অনুযায়ী, বাংলা পঞ্জিকা চালু হয় মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে। আকবর শস্যের জন্য কর গ্রহনের নির্দেশ দেন এবং সেই কর গ্রহণ করার জন্য প্রথম চালু হয় বাঙালি পঞ্জিকা। বাঙালি পঞ্জিকার দিন ও তারিখ দেখে শুরু হয় কর গ্রহণ। যদিও এক্ষেত্রে মতান্তর আছে অনেকের মতে পঞ্জিকার সূচনা বাদশা হোসেন সাহ র আমলে থেকে। শুধু বাঙালি পঞ্জিকা না ওড়িয়া ও আসমিয়া পঞ্জিকা র ও ব্যবহার হয় ব্যাপকহারে তবে বাঙালি পঞ্জিকার সাথে বিভিন্ন পঞ্জিকার মতপার্থক্যে আছে। বাঙালি পঞ্জিকা মুলতঃ বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত ও সূর্যসিদ্ধান্ত মতে বিভক্ত। সূর্যসিদ্ধান্তের সূচনা হয় প্রায় ১০০০ খ্রীস্ট প্রঃ এ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মতকেই গ্রহণ যোগ্য বলে মনে করা হয়। বাজারে যে সকল প্রকার পাঞ্জিকা মেলে পি এম বাগচি থেকে বেনীমাধব শীল সবাই সূর্যসিদ্ধন্তেই বিশ্বাসী। তবে বেলুড় মঠের পুজো হয় বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত মতে। বিশুদ্ধসিদ্ধান্তের জন্ম হয় ১৮৯০ সালে সূর্যসিদ্ধান্তের কিছু সংশোধনের উপর নির্ভর করে। পরবর্তী কালে এই মত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সময়ের সাথে পঞ্জিকার বাহ্যিক রূপের ঘটে আমুল পরিবর্তন। বাজারে খুব সহজেই ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা ও পকেট পঞ্জিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাধারনের। শুধু দিন বা তারিখ নির্নয় না বাঙালির ঠাকুর ঘরে পঞ্জিকা এক মুল্যবান অলংকারের ন্যায় রঞ্জিত হতে থাকে। ব্রিটিশ আমলে বাংলা হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের আতুর ঘর, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ধার্মিক জটিলতা আরও এক নতুন সমস্যা হয়ে ওঠে। ধার্মিক আখ্যান ও মহাকাব্য গুলোর মতো পঞ্জিকাও নিজ মাহাত্ম্য হারায়। তখন পন্ডিত বিশ্বম্বর প্রথম হাতে লিখে পাঞ্জি রচনা করেন, পরে ১৮৬৯ সালে তার প্রিন্টেড ভার্সন প্রকাশ পায় সাধারণ মানুষের কাছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত পাঞ্জি কে বাঙালি জীবনের এক অবিছেদ্য রূপ হিসেবে দেখা যায়। মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকা ১৯৩০ সালে প্রথম বাজারে প্রবেশ করে। গোটা পঞ্জিকাটি ছিল হালকা গোলাপি মলাটে রাংান। দুরদর্শন বা রেডিও তখন ও বাজারে আসে নি। তাই পঞ্জিকার মলাটকে ব্যবহার করা হত বিভিন্ন ব্যবসায়ীক কাজের জন্য। মলাটের পিছনে দেখা যেত বহু কঠিন রোগ নিরাময়ের ওষধির বিজ্ঞাপন। পাঞ্জি তে থাকত আরও নানান খবর। পঞ্জিকা শুধু বাঙালি গিন্নীর পুজোর থালা বা ঠাকুর মশইয়ের হাতে সুসজ্জিত বই নয়। বরং যুগের পর যুগ ধরে পঞ্জিকা বাঙালি জনজীবনের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিছে। শুধু সাধারণ দোকান না পঞ্জিকা শপিং সেন্টারে ও সহজেই পাওয়া যায়। এই টেকনলজির যুগে পঞ্জিকা হারিয়ে তো যায়ইনি উপরন্তু এটি এখন এপ্যাও মেলে ডিগিটাল ফরমেট। পঞ্জিকার ব্যবহার ছাড়া আমদের কোনো অনুষ্ঠানই সম্ভব না তাই পয়লা বৈশাখের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি ও ঠাকুর ঘরে উঁকি মেরে দেখুন পঞ্জিকা টি আছে তো?