“বেহুলার মান্দাস জলে ভেসে চলে, বেহুলা নাচুনী স্বর্গেতে চলে…” মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের পৌরাণিক গল্প সকলেরই প্রায় জানা। কিন্তু পরিচালক মনীশ মিত্রের ভাবনায় তা যেন এক অন্য রূপ পেয়েছে। ন্যাযাট সুন্দরবন নাট্যউৎসব কমিটির নাটক দেবী মঙ্গলকাব্য প্রথমবারের জন্য কলকাতার অ্যাকাডেমী অফ ফাইন আর্টসে মঞ্চস্থ হল। এর আগে বেশ কয়েকবার সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে খোলা আকাশের নীচে বিদ্যাধরী নদীর তীরেই তা পরিবেশিত হয়েছে। একঝাঁক নতুন তারকা যাদের বেশীরভাগই কখনও মঞ্চে অভিনয় করেনি, তথাকথিত অভিনয় জগতের সাথে পরিচিতও নয়, তাদের অনেকেই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে এসেছে সেই থিয়েটারে অভিনয় করতে। সেইসব ছেলেমেয়েদের নিয়েই তৈরী এই দেবী মঙ্গলকাব্য। তাই কোথাও যেন তাদের জীবনের সাথেও জড়িয়ে গেছে এই মঙ্গলকাব্য। পরিবেশনা, অভিনীত চরিত্ররের মধ্যে দিয়ে দর্শকও উপভোগ করেছে গ্রাম বাংলার লৌকিক জীবনগাথা, যা কখনই আর সীমাবদ্ধ থাকেনি পৌরাণিক গল্পে কিংবা কবিতার পঙক্তিতে। পরিচালক মনীশ মিত্রের সেই ভাবনা ও নির্দেশনায় অতি পরিচিত ও প্রচলিত পৌরাণিক গল্পটি রূপ পেয়েছে গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ এক নারীর জীবনগাথায়। পরিচালক তার দেবী মঙ্গলকাব্যে বেহুলার যে রূপ তুলে ধরেছেন তা গ্রামবাংলার একা অসহায় এক নারীর কথাই বলে। যে তার নিজের মনের জোরে সদ্য বিবাহিত স্বামীর মরদেহ মান্দাসে ভাসিয়ে নিয়ে দেবতাদের কাছে যায় স্বামীর প্রাণ ভিক্ষার্থে। সমাজের লাঞ্ছনা, অপমান, কটূক্তি, প্রতিকুল পরিবেশ পরিস্থিতি উপেক্ষ্যা করে স্বামীর মরদেহ কোলে বেহুলা পৌঁছায় স্বর্গে দেবতাদের গৃহে। সেই স্বর্গে যেখানে কন এক জন্মে সে দেবতাদের নর্তকী বলেই পরিচিত ছিল। আবার তাদেরই অভিশাপে বেহুলা মর্ত্যের নারী। মনসামঙ্গল যেহেতু সুন্দরবনের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত; প্রতিকুল পরিবেশেই এখানকার মানুষ অভ্যস্ত, তাই পরিচালক মনীশ মিত্র এই অঞ্চলের স্থানীয় গ্রামবাসীকেই বেছে নিয়েছেন তার নাটকের চরিত্রায়নে; যা প্রতিনিয়ত নাটোকের অভিনয়কে ছাপিয়ে বাস্তবে রুপায়িত হয়েছে। নাটোকের সেট, চরিত্রের সাজপোশাকও সেখানে আটপৌড়ে, অতি সাদামাটা। তাদের সকলের সহজ সরল অভিনয়ই যেন অনেকবেশী পেশাদার করে তুলেছে তাদের। “একদিনে সকাল থেকে তিনটি নাটোকের শো হয়েছে অ্যাকাডেমীতে এই দলেরই। প্রায় জনাপঞ্চাশেক সদস্য নিয়ে তৈরি দেবী মঙ্গলকাব্য কলাকুশলীদের সকলেই কলকাতার মঞ্চে আসতে পারেনি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য। সুতরাং এথেকেই অনুমান করা যায় শিল্পীদের বয়স”, জানালেন পরিচালক।