প্রতিবেদন – অর্পিতা দে
রসনা তৃপ্তির ক্ষেত্রে বাঙালীর জুড়ি মেলা ভার। সে মিষ্টি সুখেই হোক কি গরমের দিনে গলা ভেজাতে শরবৎএ । সে এক দিন ছিল যখন গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়িতে অতিথি এলে বাড়ির মহিলারা প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে, নিজের হাতে তৈরী দইয়ের ঘোল, লেবুর জল কিংবা আম পোড়ার শরবৎ পরিবেশন করতেন অতিথিদের; এমনকি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও পরিবেশিত হতো এইসব হাতে তৈরী শরবৎ। সময়ের সাথে সেইসব শরবৎ তার কদর হারিয়েছে। তার বদলে এখন সময় বাঁচাতে বাজারের সিন্থেটিক কিংবা রেডিমেড ফলের রস আর ঠাণ্ডা পানীয় জায়গা বদল করে নিয়েছে হাতে তৈরী দইয়ের ঘোল কিংবা শরবৎএর। ১৯০৭ সালে হৃষীকেশ শ্রীমানি বাঙালীর প্রথম শরবৎ এর দোকান ‘কপিলাশ্রম’ তৈরী করেন উত্তর কলকাতার ২০৪/২ বিধান সরণীর উপর, শ্রীমানি মার্কেটের পাশে। হৃষীকেশ শ্রীমানির বর্ষীয়ান কন্যা শুভা দে জানালেন, “কপিল মুনির আশ্রম থেকে বাবা অর্থাৎ হৃষীকেশ শ্রীমানি দোকানের নাম দিয়েছিলেন কপিলাশ্রম। প্রথম জীবনে একটা বইয়ের দোকানে কাজ করতেন সেখানে এক ইংরেজ সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হয়; তিনিই বাবাকে অনুপ্রেরণা যোগান নিজে কিছু করার। সেই ইংরেজ সাহেবই তাঁকে বম্বেতে নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়িতে রাখেন। সেখানে তিনি সাহেবের কাছে শরবৎ তৈরী শেখেন। ইংরেজ সাহেব তাঁকে নিজে হাতে করে শরবৎ এ সিরাপের পরিমাণ, দই এর পরিমাণ শেখান। কোথা থেকে শরবৎ এর জন্য সিরাপ কিনবেন, সব কিছু বলে দেন। এরপর কলকাতায় ফিরে শ্রীমানি মার্কেটের ওই একফালি দোকান ঘর ভাড়া হিসেবে নেন। সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু করেন শরবৎ এর ব্যাবসা। আগে বাড়ীতেই দই তৈরী হতো। দুধ আসতো নতুন বাজার থেকে। তখনকার আরোরা কম্পানী থেকে আসতো বিভিন্ন ধরনের সিরাপ। বিদেশ থেকে আসতো কলার একধরনের সিরাপ। কোনটার সাইজ এক আঙুলের মতো আবার কোনোটা অসুধের বোতলের মতন। সারা বাড়ি ফলের গন্ধে ভরে থাকতো আমাদের। তিনি নিজে হাতে শরবত তৈরী করে দিতেন। দই মাপার জন্য ছিল একটা কাপ আবার সিরাপের পরিমানের জন্য ছিল আরেকটা। বাবা বাড়ি ফিরতেন রাত দেড়টায়। তখন আমরা বাড়ি থেকে বিশেষ বের হতাম না, ওনার মুখেই শুনেছি রাতে দোকানের সামনে লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়াতো শরবত খাবার জন্য।বাবার সবচেয়ে বেশী হৃদ্যতা ছিল জোড়াসাঁকোর অবাঙালিদের সাথে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের দোকানের শরবৎ পাঠানো হতো। তবে দেব সাহিত্য কুটিরের বাড়ির কোন অনুষ্ঠান হলে বাবা নিজের হাতে শরবৎ বানিয়ে দিতেন। একবার শহরের এক বিশিষ্ট শরবৎ বিক্রেতা সংস্থা বাবাকে সেইসময় পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে শরবৎ এর পদ্ধতি ও সত্ব কিনে নিতে চেয়েছিল কিন্তু বাবা তাদের ফিরিয়ে দেন”। বাঙালীর প্রথম শরবৎ এর দোকান আজও তার ঐতিহ্যে বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। তবে সময় বদলালেও বদলায়নি তার স্বাদ আর গন্ধ। বদল হয়নি শরবৎ তৈরীর পদ্ধতিও। অত্যন্ত কম দামে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫ টাকার মধ্যে আজও পাওয়া যায় দই, মালাই দিয়ে তৈরী কেসর মালাই, রোস, গ্রীন ম্যাঙ্গ, পাইনাপেল, লিচুর শরবত। “বঙ্গ সংস্কৃতির সন্মেলনের মেলায় আমাদের শরবতের স্টল দেওয়া হতো। আমার বাবার কাছে শুনেছি বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তি বড়দাদুর হাতে তৈরী শরবত খেয়ে গেছেন” জানালেন আদি কপিলাশ্রমের বর্তমান অধিকর্তা এবং তৃতীয় প্রজন্ম প্রনবেন্দু শ্রীমানি। “আগে দশ পনেরো বড় হাঁড়িতে দই আসতে দেখেছি ওনাদের। স্কুলে পড়ার সময় এখান থেকে শরবত খেয়ে বাড়ি ফিরেছি; ফুটপাথে লম্বা লাইন পড়তো ওনাদের শরবত খাওয়ার। তখন এখানে কোন বাড়ি ছিল না। রবীন্দ্রমেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র সকলেই হৃষীবাবুর হাতে তৈরী সরবত খেয়েছেন”, জানালেন বছর ৭৩ এর স্থানীয় বাসিন্দা দিলীপ সিংহ। ২০৪/২ বিধান সরণীর সামনে গেলেই আজও নাকে আসে শরবৎ এর মাতানো গন্ধ আর মগের মধ্যে কাঠের কাটা ঘোরানোর খটাখট শব্দ। যারা জানেন তারা আজও আসেন ভিড় জমান প্রায় সারা বছরই বাঙালীর পুরানো ঐতিহ্যের শরবৎ এর স্বাদ নিতে।